গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যে মাওবাদীদের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় নেতা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজি রাখঢাক না-করে ঘোষণা করেছিলেন— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান তাঁরা। সেই ঘোষণার পরে প্রায় পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে। জঙ্গলমহলে যৌথ বাহিনীর অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন কিষেণজি। সেই মাওবাদীদের ‘কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরো’ এখন বিবৃতি দিয়ে জানাচ্ছে, তাদের কাছে ‘মমতার আসল চরিত্র অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে’। এতটাই পরিষ্কার হয়েছে যে, ‘মমতা সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে লালগড় আন্দোলনের মতো দুর্বার ও সশস্ত্র জঙ্গি আন্দোলন’ গড়ে তুলতে রাজ্যের জনগণের উদ্দেশে আহ্বান জানাচ্ছে মাওবাদীরা।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দিন কয়েক আগে রাজ্যকে সতর্কবার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছে, কিষেণজির হত্যার বদলা নিতে মাওবাদীদের ৭০-৮০ জনের একটি দল ঝাড়খণ্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগে বড় হামলা চালাতে পারে। গোয়েন্দাদের একাংশের খবর, ওই ঘাতক বাহিনীতে ছত্তীসগঢ়ের কয়েক জন মহিলা
জঙ্গিও আছে। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার বলেন, ‘‘শুধু ১৫ অগস্ট বলে নয়, মাওবাদী বা অন্য কোনও জঙ্গি সংগঠনের যে কোনও রকম পদক্ষেপের উপরে আমরা কড়া নজর রাখছি।’’ এই পরিস্থিতিতে মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরোর এই প্রকাশ্য বিবৃতিটি খুবই তাৎপর্যবাহী।

বিবৃতিতে মাওবাদীরা স্বীকার করে নিয়েছে যে, মমতার শ্রেণিচরিত্র নিয়ে তাঁদের ধারণার অভাব ছিল এবং লালগড় আন্দোলন পর্বে তাঁকে সমর্থন করাটাও দলের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। পাঁচ বছর পরে তাদের উপলব্ধি— ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল সরকারে আসার পরে জনগণের মৌলিক সমস্যার একটিরও সমাধান হয়নি। তৃণমূল আমলে উৎকোচ গ্রহণ ও দুর্নীতি অনেকটাই বেড়েছে— সারদা কেলেঙ্কারি যার একটা নমুনা মাত্র।... আসলে ক্ষমতায় আসার জন্য মাওবাদীদের ব্যবহার করেছেন মমতা ও তাঁর দল’। ওই বিবৃতিতেই দাবি করা হয়েছে, মাওবাদীদের পলিটব্যুরো সদস্য ও ‘লালগড় আন্দোলনের প্রিয় নেতা’ কিষেণজিকে হত্যার ষড়যন্ত্রে ‘মমতার লিপ্ত থাকার ঘটনা আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।’
নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ না ভুয়ো সংঘর্ষ— ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর কিষেণজি কী ভাবে মারা যান, এই বিতর্ক সম্প্রতি নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কারণ, তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় গত মাসে বেলপাহাড়ির এক জনসভায় মন্তব্য করেন— কিষেণজিকে হত্যা করাটা মমতা সরকারের একটা সাফল্য। তার দিন দশেকের মধ্যেই মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটি তাদের পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরোর বিবৃতিটি প্রকাশ্যে এনেছে। যদিও বিবৃতিটি জারি করা হয়েছিল গত বছর অক্টোবর মাসে, সিপিআই (মাওবাদী) পার্টি প্রতিষ্ঠার দশম বার্ষিকী উপলক্ষে। কিন্তু এত দিন এটি গোপনে রাখা হয়েছিল।
বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বেশ কয়েক বার বলেছিলেন, ‘‘তৃণমূলের সক্রিয় সহযোগিতাতেই জঙ্গলমহল-সহ রাজ্যের কোথাও কোথাও মাওবাদীদের প্রভাব বাড়ছে।’’ কিন্তু তখন বিরোধী পক্ষে থাকা মমতা মাওবাদীদের সঙ্গে তাঁর দলের যোগসাজশের কথা কখনই স্বীকার করেননি। তিনি তখন বলতেন, ‘‘মাও-ফাও বলে কিছু নেই। সবই আসলে সিপিএম। এরা দিনে মার্কসবাদী, রাতে মাওবাদী।’’ কিন্তু মাওবাদীদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘লালগড়ের উত্তাল সময়ে বিপ্লবী আন্দোলনকে বিপথগামী করতেই বন্ধুর ভেক ধরে উপস্থিত হন মমতা ও তাঁর দল তৃণমূল। সে সময়ে মমতার মিটিং-মিছিলে নিজেদের সমর্থক পাঠানোটা ভুল হয়েছিল। বেশি দিন ভাঁওতা দেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। এটা মমতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য’।
‘পশ্চিমবঙ্গের জনগণের কাছে সিপিআই (মাওবাদী)-র আহ্বান’ শীর্ষক এই বিবৃতিটিতে বলা হয়েছে, মমতার ‘প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র’ যেমন তাঁর সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, তেমনই গত সওয়া চার বছরে মমতা নিজের মুখোশ নিজেই উন্মোচন করেছেন। উদাহরণ হিসাবে মাওবাদীরা বলছে, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও ক্ষমতায় এসে কোনও মাওবাদী বন্দির ক্ষেত্রেই তিনি সেটা প্রয়োগ করেননি। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে জঙ্গলমহল থেকে যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার করার কথা থাকলেও মমতা আজও সেটা করেননি।
মমতা ২০১০-এর ৯ অগস্ট লালগড়ে এক জনসভায় ‘মিথ্যা সংঘর্ষে মাওবাদী নেতা কমরেড আজাদকে হত্যা করা হয়েছে’ বলে সুবিচার চান। মাওবাদীদের বক্তব্য, নিজেকে প্রগতিশীল হিসেবে জাহির করতেই মমতা ওই কথা বলেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সেই সব বিশ্বাস করে তাঁর প্রতি মোহগ্রস্ত হয়েছিলেন। ‘ক্ষমতায় এসে মমতা ১৮০ ডিগ্রি ডিগবাজি খেয়েছেন’— মন্তব্য মাওবাদীদের।
তবে লালগড় আন্দোলন পর্বে কিষেণজিই বলেছিলেন, মমতাকে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। এই নিয়ে তদানীন্তন রাজ্য সম্পাদক কাঞ্চন ওরফে সুদীপ চোংদারের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়। মমতাকে না-চেনার ভুলের মতো আরও একটি ভুল ওই বিবৃতিতে মাওবাদীরা এত দিনে স্বীকার করেছে। তারা বলেছে, ‘লালগড়ে নির্বিচার হত্যা ও লাশ গায়েব করাটাও ভুল হয়েছিল’।
মাওবাদীদের বিবৃতি নিয়ে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব কিছু বলতে চাননি। সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিমের মন্তব্য, ‘‘মাওবাদীরা তো নিজেরাই ব্যবহৃত হয়েছেন। তৃণমূলের মতো দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করেছেন।’’ সেলিমের কথায়, ‘‘কাজের বেলায় কাজি, কাজ ফুরালে কিষেণজি—মমতার এই নীতি কিন্তু সবাই মেনে নেবে না।’’ একই সঙ্গে সেলিমের হুঁশিয়ারি, ‘‘মাওবাদীরা যদি ফের হিংসার পথে ফেরে, তা হলে আমরা তীব্র প্রতিবাদ করব।’’