পঞ্চাশ কিলোমিটারের দূরত্বও ঘুচে গেল। ৩০ সেপ্টেম্বর দিল্লির অদূরে দাদরিতে ‘গোমাংস’ খাওয়ার জন্য পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল প্রৌঢ় মহম্মদ আখলাখকে। আর এ বার খাস রাজধানীর যন্তর মন্তর রোডে কেরল ভবনের ক্যান্টিনে হানা দেওয়া হলো গোমাংস দিয়ে তৈরি ‘বিফ ফ্রাই’-এর খোঁজে।
বিহারে তৃতীয় দফার ভোটের ঠিক দু’দিন আগে দিল্লিতে এ ভাবে গোমাংস বিতর্ক মাথা চাড়া দেওয়ায় বিরোধী দলগুলো বলতে শুরু করেছে, মেরুকরণের রাজনীতি করাই লক্ষ্য সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপির। বিহারে ভোট প্রচারে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী মুখে শুধু উন্নয়নের কথা বলছেন। কিন্তু খোদ রাজধানীতে বিজেপি-আরএসএস অন্য খেলা খেলে বিহারের ভোটকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। বরাবর এই দ্বিমুখী রাজনীতিই করে
এসেছে সঙ্ঘ-বিজেপি। এ বারেও তার ব্যতিক্রম নয়।
ঠিক কী ঘটেছিল গতকাল?
কেরল ভবনের সমৃদ্ধি ক্যান্টিন সূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবার দুপুরে সেখানে হাজির হন এক মালয়ালি ও দুই কন্নড় ব্যক্তি। তাঁরা জানতে চান, মেনুতে লেখা ‘বিফ ফ্রাই’তে কি গরুর মাংস ব্যবহার করা হয়? ক্যান্টিনের দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি জানান, দিল্লিতে গরু খাওয়া নিষিদ্ধ। তাই মোষের মাংস দিয়ে এই ‘বিফ ফ্রাই’ রান্না করা হয়।
এখানেই ঘটনার শেষ নয়। এর ঘণ্টা দুয়েক পরে কেরল ভবনে হাজির হয় জনা কুড়ি পুলিশের এক দল। তাদেরও বলা হয়, গরুর মাংসের কোনও পদ এই ক্যান্টিনে পাওয়া যায় না। ‘বিফ ফ্রাই’ তৈরি হয়, মোষের মাংস দিয়েই। পুলিশের দল তখন চলে যায়। ঝামেলার আশঙ্কায় ‘বিফ ফ্রাই’ তখনকার মতো তৈরি ও বিক্রি বন্ধ করে দেয় সমৃদ্ধি ক্যান্টিন।
কেন হাজির হলো পুলিশ?
পুলিশের সূত্রে খবর, গত কাল হিন্দু সেনা সংগঠনের বিষ্ণু গুপ্ত নামে এক ব্যক্তি দিল্লি পুলিশকে ফোন করে জানান, কেরল ভবনের ক্যান্টিনে গোমাংস রান্না ও বিক্রি হচ্ছে। অনভিপ্রেত কোনও ঘটনা যাতে না ঘটে, তাই দেখতে ক্যান্টিনে গিয়েছিল পুলিশ। দিল্লি পুলিশ কমিশনার বি এস বাস‌‌্সি সাফাই দিয়ে বলেছেন, ‘‘পুলিশ কন্ট্রোল রুমে আমরা একটি ফোন পাই। যে ব্যক্তি ফোন করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে অতীতে আইন নিজের হাতে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তবু কোনও ফোন কল এলে তা খতিয়ে দেখা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’’

কালকের ঘটনার নিন্দায় এককাট্টা হয়েছে বিজেপি-বিরোধী দলগুলো। তাদের প্রশ্ন, কী ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা দিল্লি পুলিশ কেরল ভবনে গিয়ে হানা দিতে পারে? দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল টুইটে মন্তব্য করেন, ‘‘এটি সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত। কে কী খাবে, কী পরবে তা বিজেপি সরকার বা দিল্লি পুলিশ কি স্থির করে দেবে!’’
ঘটনার নিন্দা করে কেরলের কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী উমেন চান্ডি চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রীকে। কোঝিকোড়ে তিনি আজ বলেন, ‘‘কেরল ভবন তো কোনও হোটেল নয় যে দিল্লি পুলিশ এ ভাবে ঢুকে পড়বে। দিল্লি পুলিশ তাদের এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে কাজ করেছে। সেখানে তখন রাজ্যের অনেক বড় বড় নেতা ছিলেন। সামান্য সৌজন্যটুকুও দেখায়নি দিল্লি পুলিশ।’’ চান্ডির হস্তক্ষেপে আজ থেকে ক্যান্টিনে ফিরে এসেছে ‘বিফ ফ্রাই’।
আগামিকাল দিল্লিতে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক। সেখানে যোগ দিতে বেশ কিছু সিপিএম নেতা-সাংসদ কেরল ভবনে এসে রয়েছেন। আজ পুলিশি হানার প্রতিবাদে কেরল ভবনে ধর্নায় বসেন তাঁরা। মুখে স্লোগান, ‘আমার খাবার, আমার অধিকার’। পরে কেরল ভবনের সামনে মিছিলও বার করা হয়। কেজরীবালের নির্দেশে আম আদমি পার্টির নেতারাও
বিক্ষোভ দেখান। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই ঘটনার নিন্দা করে টুইট বার্তায় বলেন, ‘‘কেরল ভবনের ঘটনার আমি ঘোরতর নিন্দা করছি। মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার একটি অস্বাস্থ্যকর প্রয়াস। অসহিষ্ণুতার পরিচয়।’’
কিন্তু এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, বিহার ভোটের দু’দিন আগে হিন্দু সেনার দু’জন ব্যক্তি পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লিতে হাঙ্গামা বাধালেন, এটি কি নেহাতই একটা ছোট দলের কাজ? নাকি এর পিছনে রয়েছে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত? আর পুলিশই বা এত সক্রিয় হয়ে কী করে সরাসরি অন্য একটি রাজ্যের ভবনে হানা দিল? যখন এই হিন্দু সেনা সংগঠনের সদস্যরাই
দিন কয়েক আগে ‘বিফ পার্টি’ করার ‘অপরাধে’ দিল্লিতেই জম্মু-কাশ্মীরের এক নির্দল বিধায়কের মুখে কালি ছিটিয়ে দিয়েছিল!
বিরোধীদের দাবি আরও প্রকট হয়েছে, যখন আজ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রীতিমতো বিবৃতি জারি বলেছে, কেরল ভবনের মেনুতে ‘বিফ’ শব্দটি ব্যবহার করাও বেআইনি। গোটা দুনিয়ায় ‘বিফ’ মানে গোমাংসই বোঝানো হয়। যারা এই গোমাংস পরিবেশন করছে ও যাঁরা এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিরোধিতা করছেন, তাঁদের সকলের বিরুদ্ধেই দিল্লি পুলিশের উপযুক্ত পদক্ষেপ করা উচিত, বলে দাবি পরিষদের। বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা হতে থাকায় বিজেপি নেতা বেঙ্কাইয়া নায়ডু বলেন, ‘‘কিছু ব্যক্তির অভিযোগ পেয়ে পুলিশ খতিয়ে দেখতে গিয়েছিল। সেই ঝামেলা মিটে গিয়েছে।’’
সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত কন্নড় লেখক এম এম কালবার্গির হত্যা বা উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে সংখ্যালঘু হত্যার প্রতিবাদে মাস খানেক ধরে জোর সামলোচনার মুখে পড়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সহিষ্ণুতার বার্তা দিলেও প্রধানমন্ত্রী দু’য়েক বার ছাড়া বিশেষ মুখ খুলছেন না। যেমন কালকের ঘটনাতেও নীরব তিনি।
আর পুলিশ কী করছে? দাদরি থেকে ফ্রিজে রাখা মাংস ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য নিয়ে এসেছিল তারা। কালও কি ক্যান্টিন থেকে ‘নমুনা’ নিয়ে এসেছে?
‘‘সে গুড়ে বালি’— হাসলেন সমৃদ্ধি ক্যান্টিনের এক নিয়মিত খরিদ্দার। ‘‘দুপুর তিনটের পরে গেলে পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে তৈরি ওই ঝাল ঝাল মাংসের এক কণাও আপনার জুটবে না!’