অসহিষ্ণুতার অভিযোগে বিদ্ধ বাংলাদেশের শাসক দলও।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সুপ্রিম কোর্টে প্রথম অমুসলিম প্রধান বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে শেখ হাসিনার আমলে। গত বছর ১৭ জানুয়ারি দায়িত্ব নেওয়া সেই বিচারপতি সুরেন্দ্রকুমার সিন্হাই এখন সরকারের একটা প্রভাবশালী অংশের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মন্ত্রীর বিবৃতি এবং অভিযোগ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, রবিবার খোদ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকেও প্রতিবাদ জানাতে হয়েছে। তিনি বলেছেন, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে মন্ত্রীদের অনাস্থাসূচক বিবৃতি বিচার বিভাগের অবমাননার সামিল। এর ফলে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে, যা আদৌ কাম্য নয়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেনও মন্ত্রীদের ‘ঔদ্ধত্যের’ সমালোচনা করে বলেছেন, ‘‘বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সরকার। এটা বন্ধ না হলে ন্যায় বিচারের শেষ আশ্রয়স্থল সুপ্রিম কোর্ট সম্পর্কে আস্থা হারাবেন দেশবাসী।’’

কিন্তু এই সমালোচনার পরেও ক্ষান্ত হতে রাজি নন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, যিনি সব চেয়ে বেশি সরব প্রধান বিচারপতি সিন্হার বিরুদ্ধে। অ্যাটর্নি জেনারেলকে এক হাত নিয়ে সাবেক এই আইন প্রতিমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, ‘‘বিরোধী দল ও অ্যটর্নি জেনারেল একই সুরে কথা বলছেন।’’
প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে মন্ত্রীদের উষ্মার কারণ কী?
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পরে সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছেন জামাতে ইসলামির নেতা মীর কাসেম আলি। প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত একটি বেঞ্চে এই মামলাটি চলছে। সম্প্রতি সেই মামলার শুনানির সময়ে প্রধান বিচারপতি সরকারি কৌঁসুলিদের সমালোচনা করে বলেন, তাঁরা ঠিক মতো কাজ করছেন না। প্রসিকিউটররা রাজনীতিকদের মতো আচরণ করছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এর পরেই শাসক দলের একটি অংশ থেকে বিচারপতি সিন্হার বিরুদ্ধে কামান দাগা শুরু হয়। তিনি পাকিস্তান সরকারের সহযোগী ‘শান্তি কমিটির’ সদস্য ছিলেন বলেও অভিযোগ করা হয়। সরকারে একটি মহল একে শাসক দলের অসহিষ্ণুতার প্রকাশ বলেই মনে করছেন। শনিবার খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম দাবি করেন, প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে মীর কাসেম আলির আপিলের পুনর্বিবেচনা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকও বলেন, প্রধান বিচারপতির উচিত যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া থেকে সরে যাওয়া। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অবশ্য বিযয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন। বিশিষ্ট এই আইনজীবী বলেন, ‘‘আমি তো ছাপোষা উকিল ছিলাম না। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে মুখ খোলা যে উচিত নয়, সেই বোধটুকু আমার রয়েছে।’’ অনেকে বলছেন, ‘ছাপোষা উকিল’ বলে আসলে কামরুলকেই ব্যঙ্গ করেছেন আইনমন্ত্রী।
রবিবার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, বিরোধীরা যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। মন্ত্রীরাই যদি প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিতর্কিত কথা বলেন, বিরোধীরা সুযোগ নেবে।
কিন্তু কামরুল রবিবারও বলেছেন, ‘‘জামাতে ইসলামি, বিএনপি যে সুরে অভিযোগ করছে, সেই সুরে কথা বলছেন প্রধান বিচারপতিও।’’ কিন্তু প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অনাস্থা প্রকাশ কি আদালত অবমাননা বা সংবিধান লঙ্ঘন নয়? এই প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘‘এক জন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রতিক্রিয়া জানানোর স্বাধীনতা আমার নেই?’’
দলের একাংশ যে ভাবে বিচারপতি সিন্হার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অনাস্থা প্রকাশ করছেন, অনেক আওয়ামি লিগ নেতাও তা মানতে পারছেন না। এক নেতার ব্যাখ্যা— সুরেন্দ্রকুমার সিন্হাকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করে শেখ হাসিনা সরকার সংখ্যালঘুদের যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এখন তাঁকে এই ভাবে অপদস্থ করাটা সংখ্যালঘুরা যে ভাল ভাবে নেবেন না, সেটা ভাবা উচিত।